২০২০ সালের মার্চে সিরিয়ার উত্তর অঞ্চলে ৩৩ তুর্কি সৈন্যের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি রিচেপ তায়েপ এরদোয়ান ঘোষণা দিয়েছিলেন তার সরকার অভিবাসীদেরকে ইউরোপ প্রবেশে আর বাধা দিবে না। এ ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।বিশেষ করে অভিবাসী ও অভিবাসন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো ব্যাপক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ সিরিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার সাথে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ ঘটনায় ইইউসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তুরস্কের ব্যাপক সমালোচনা করেছিল।
শুধু তুরস্ক নয় মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বহু দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে অভিবাসন এবং নতুন আশ্রয়প্রার্থীদের আগমন বেশ চটকদার একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
দুই বছরের জন্য অভিবাসন বন্ধ চান হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী
করোনা ভাইরাসের সময়ে অভিবাসন অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করে ১১ই জুন দেশটির রাষ্ট্রীয় বেতারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেন, ‘‘দলে দলে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। এ কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে দুই বছর অভিবাসন বন্ধ রাখা উচিত৷’’
২০২১ সালে ডিসেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস এক রায়ে হাঙ্গেরির অভিবাসন বিষয়ক আইনকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা দেয়। বহুদিন ধরে অভিবাসন ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ আছে অভিবাসনবিরোধী মন্তব্যের জন্য বরাবরই সমালোচিত হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী অরবানের বিরুদ্ধে ৷
ইইউ’কে পাল্টা আক্রমণে অভিবাসীদের ব্যবহারের অভিযোগ বেলারুশের বিরুদ্ধে
লিথুয়ানিয়ায় বসবাসরত বেলারুশের একজন বিরোধী দলীয় নেতাকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে রাইয়ান এয়ারওয়েজের একটি বিমান ছিনতাই করে বেলারুশ সরকার। উক্ত ঘটনায় ইইউ বেলারুশের রাষ্ট্রপতি আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কোর উপর এবং মে মাসে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞার পরে ইউকে পালটা আক্রমণে অভিবাসীদের ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে দেশটির বিরুদ্ধে।
লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই বেলারুশ লিথুয়ানিয়া সীমান্ত হয়ে অভিবাসী আসার হার আগের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৬০০ অভিবাসী ইতিমধ্যে লিথুয়ানিয়ায় প্রবেশ করেছে। যেখানে শুধুমাত্র জুন মাসেই ছিল ৪১২ জন।”
বেলারুশের বিরুদ্ধে লিথুয়ানিয়াকে পূর্ব ইউরোপের নতুন অভিবাসন কেন্দ্র বানানোর চেষ্টার অভিযোগ এনেছে লিথুয়ানিয়া সরকার।
স্পেন মরক্কো সীমান্ত উত্তেজনা
সম্প্রতি এ বছর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মরক্কো স্পেন সীমান্ত হয়ে বিপুল অভিবাসী স্পেনের ছিটমহল সেউটায় ঢুকে পড়লে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। মরক্কোর হঠাৎ এমন আচরণের পেছনেও স্পেনের সঙ্গে দেশটির সাম্প্রতিক মনোমালিন্যের বিষয়টি উঠে এসেছে৷
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্পেনের অভ্যন্তরীণ নীতি প্রধান ভার্জিনিয়া আলভারেজ বলেন, “মরক্কো মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছে৷ এভাবে নিজেদের নাগরিকদের রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটি বানানো উচিত নয় ৷”
উল্লেখ্য, অভিবাসী আগমন তুরস্কের সাথে ইইউর যেমন বিশেষ চুক্তি রয়েছে তেমন মরক্কোর সাথেও ইইউ এবং স্পেনের বিশেষ সীমান্ত চুক্তি রয়েছে। যেটির মাধ্যমে মরক্কোকে বিশেষ অর্থ সহায়তা দিয়ে ব্যাপক হারে অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
গ্রিসের অবৈধ পুশব্যাক নীতি
পূর্ব ভূমধ্যসাগরের অমীমাংসিত অংশের নিয়ন্ত্রণ ও সামরিক মহড়া চালানো নিয়ে গত বছর ভূরাজনৈতিক সংঘাতে জড়ায় তুরস্ক ও গ্রিস। তীব্র বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স এবং ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
পরবর্তীতে, এ সমস্যার বরফ গললেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে অভিবাসীদের তুরস্ক অভিমুখে পুশব্যাক করা শুরু করে গ্রিস। এখানেও অভিবাসীরা কোন ভূমিকায় না থাকলেও রাজনৈতিক সংঘাতে অবৈধ পুশব্যাকের মতো অমানবিক ঘটনার ভুক্তভোগী হচ্ছে শরণার্থী ও অভিবাসীরা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তজার্তিক সংগঠনগুলো অভিবাসীদের বিরুদ্ধে গ্রিসের এই নীতির তীব্র সমালোচনা করে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার
ইউরোপে শরণার্থী আসা এবং অভিবাসনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালির প্রধান মারিন লো পেন ইইউ পার্লামেন্টসহ প্রায় সব জায়গায় সীমান্ত বন্ধসহ অভিবাসন বিরোধী বক্তব্য নিয়ে সারা বছর রাজনৈতিক কর্মসূচী চালিয়ে থাকেন।
ইটালির কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘লীগ’ পার্টির প্রধান মাত্তেও সালভিনিও সারা বছর অভিবাসন বিরোধী বক্তব্য দিয়ে নজরে থাকেন। অবশ্য অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃনা ছড়ানো সহ নানান অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা চলমান রয়েছে।
এছাড়া অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম সহ অনেক দেশে অভিবাসন ও কট্টর আশ্রয় পদ্ধতিকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মসূচী নির্ধারণের হার সাম্প্রতিক বছর গুলোতে ব্যাপক হারে বেড়েছে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিবাসনপ্রত্যাশী এবং শরণার্থীরা এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে অথবা অর্থনৈতিক বিপর্যয়কালে অভিবাসীদের অভিযুক্ত করে রাজনীতি করা হয়।
সুত্র :ইনফোমাইগ্রেন্টস